এক দেশে ছিল এক রাজা।
তিনি অনেক ক্ষমতাধর
হয়েও সোমগিরির রাজা
হিসেবে ছিলেন ভীষণ
দয়ালু। দেশ ও দেশের
মানুষের প্রতি তার ছিল
অসীম ভালবাসা।
প্রজাদের সুখ-দুঃখ আনন্দ-
বেদনা নিয়েই তিনি
সারাক্ষণ ভাবতেন। ফলে
সেই রাজ্যের মানুষেরা
ছিল খুব সুখি। কোনো
কিছুর অভাব ছিল না
তাদের। তারাও তাদের
রাজাকে প্রাণের চেয়ে
বেশি ভালোবাসতেন।
এত কিছু হলে কী হবে! এত
শক্তি যে রাজার, এত
সম্পদে পরিপূর্ণ
যারভান্ডার, এত বিশাল
আরমহৎ যারমন, সেই মনের
গভীর কোণে ছিল এক
নিদারুণ বেদনা। দারুণ
অসুখি ছিলেন সেই রাজা।
সব থেকেও তার যেন কিছুই
নেই। তিনি যেন ভীষণ
একা। সারাদিন আনমনা
হয়ে থাকেন। কারণ
রাজার একমাত্র সন্তান,
রাজ্যের রাজকন্যা খুব
অসুস্থ। সে দাঁড়াতেপারে
না, বসতে পারে না।
কথাও বলতেপারে না।
দিন রাত কেবলই তাকে
বিছানায় শুয়ে
থাকতেহয়। রাজকন্যার বয়স
পনের হলেও, তাকে দেখতে
এখনও শিশুটির
মতোইলাগে। ভীষণ
কষ্টতার। সবার মতো সে
চলাফেরা করতে
পারেনা, মনের কথা বলার
কোনো ভাষাও নেই
তার। ক্ষুধা পেলেও
কাউকে জানাতে
পারেনা। জীবিত
থেকেও সেযেন মৃত। সবার
মাঝে থেকেও সে যেন
সবার থেকে দূরে। দিন
যায়, মাস যায়। ঘুরতে
ঘুরতে কয়েকটা বছরও চলে
যায়। রাজ্যেরসব বড় বড়
ডাক্তার, কবিরাজ,
হেকিম-বৈদ্যদের পালা
শেষ। দূর-দূরান্তের রাজ্য
থেকেও বড় বড় ডাক্তারদের
পক্সিখরাজ ঘোড়ায় করে
নিয়েআসা হল।
কিন্তুকিছুতেই কিছুহল না।
সকলেরই এক কথা। এঅসুখ
কিছুতেই সারবার নয়।
শেষেরাজা আর কী করেন!
মনের দুঃখে যেন সব কিছুই
ভুলে গেলেন। ভুলে গেলেন
তার প্রাণপ্রিয় দেশের
কথা, প্রজাদের কথা,
এমনকি ভুলে গেলেন আহার-
নিদ্রার কথাও। তারপর
একদিন রাতের
অন্ধকারেকাউকেকিছুনা
বলে বেরিয়ে পড়লেন
রাজপ্রাসাদ থেকে।
সবাই যখন গভীর ঘুমেঅচেতন,
তখন পোশাক পাল্টে চলে
গেলেন রাজ্য ছেড়ে। দিন
যায়, মাস যায়, কেউ আর
রাজার কোনো সন্ধান
পায় না। ঘুরতে ঘুরতে
বছরখানেক পরে রাজা
এসে পড়লেন এক জঙ্গলে। সে
কী ভয়ংকর জঙ্গল! বাঘ,
ভাল্লুক আর নানা বিষাক্ত
সাপে পরিপূর্ণ সেই জঙ্গল।
এদিকে রাজার ভীষণ
ক্ষুধা পেয়েগেল।
খাদ্যের সন্ধানে রাজা
ঘুরে বেড়াতে থাকেন
এদিকে সেদিকে।
কিন্তুবনের ভেতরে এত গাছ,
কোনো গাছে কোনো
ফল নেই। অনাহারে-তৃষ্ণায়
রাজার প্রাণ যায় যায়।
শেষেক্লান্ত হয়ে এক
গাছের নিচে বসে পড়লেন
রাজা। ঠিক সেই সময়
গাছের পাশ দিয়ে কলসি
কাঁখেযাচ্ছিল এক ছোট্ট
মেয়ে। কী সুন্দর মিষ্টি
দেখতে! ছোট্টফুটফুটে
গোলাকার মুখে দুটি বড়
বড় চোখ। আর সেই চোখে
যেন রাজ্যের কৌতূহল।
রাজা তো ভীষণ অবাক।
কী আজব ব্যাপার! এই ভয়ঙ্কর
জঙ্গলে এত সুন্দর ছোট্ট
মেয়েএল কোথা থেকে?
রাজা মেয়েটিকে
ডাকলেন। মানুষের কন্ঠ
শুনেমেয়েটি তো প্রথমে
অবাক। পরে রাজাকে
দেখতেপেয়ে এগিয়ে
গেল। মেয়েটি
এগিয়েযেতেই রাজা
বললেন-“মা, দারুণ তৃষ্ণা
পেয়েছে। একটুজল
খাওয়াবে?” মেয়েটি জল
দিতেই রাজা যেন
প্রাণে বাঁচলেন। তারপর
বললেন, “কে তুমি মা? এই
ভয়ঙ্করজঙ্গলেএকা একা কী
করছ? এখানে এলে-ই বা
কোথা থেকে?” মেয়েটি
জানাল, এই জঙ্গলের মধ্যেই
একটা ছোট্টকুটিরে
মেয়েটি তার মায়ের
সঙ্গে থাকে। বাবা
মারা গিয়েছেন জন্মের
আগেই। আগে মা আর মেয়ে
দুজনে জঙ্গল থেকেফুল তুলে
মালা গেঁথেবিক্রি করত।
মা অসুস্থ বলে, এখন তাকে
একা-একাই সব কাজ করতে
হয়। সারাদিন ফুলবিক্রি
করেপানি নিয়েবাড়ি
ফিরছিল মেয়েটি।
আরতখনই রাজার সঙ্গে
দেখা। মেয়েটির কথা
শুনে ভীষণ দুঃখ হল
রাজার। এত ছোট্ট একটি
মেয়ে, অথচ কত কষ্টেরজীবন
তার! মেয়েটির মাথায়
হাত বুলিয়েদিলেন
রাজা। এই অভাবিত
স্নেহে মেয়েটি
একেবারে বিগলিত হয়ে
পড়ল। সে কখনও তার
বাবাকে দেখেনি। এই
লোকটিকে দেখে
তারনিজের বাবার কথা
মনে পড়েগেল। বাড়ির
পাশে তার বয়সী
মেয়েদের সে দেখেছে,
তাদের বাবারা তাদের
কত আদরকরে। মেলা থেকে
কত কী কিনে এনে দেয়।
কী সুন্দর বাড়িতে ঢুকেই
‘মা’, ‘মা’ বলে
ডাকতেথাকে। কই, তাকে
তো কেউএভাবেডাকে
না। কতদিন সে লুকিয়ে
লুকিয়ে কেঁদেছে। আজ এই
অপরিচিত লোকটিকে
দেখে তারমনেহল, তার
বাবা বুঝি এমনই ছিল।
তার বাবা থাকলেতাকে
বুঝি এভাবেই মা বলে
ডাকত! চোখ দুটো ছলছল
করেউঠল মেয়েটির। সে
রাজাকে বলল, “চলুন
আমাদের বাড়িতে। আমার
মা আপনাকে দেখেখুব খুশি
হবেন।” মেয়েটির কথায়
রাজা কেমন যেন অভিভূত
হয়েগেলেন।
মেয়েটিরসঙ্গে তাদের
বাড়িতে গিয়েদেখেন,
একটি জীর্ণ পর্ণকুটির।
ভেতরে একটা পাটি
বিছিয়ে শুয়ে আছে এক
অসুস্থ নারী। মেয়েটি
মায়ের সঙ্গেরাজার
পরিচয় করিয়ে দিল।
মেয়েটির মায়ের সঙ্গে
অনেক কথা হল রাজার।
রাজা কিন্তুনিজের
পরিচয় দিলেন না। কেউ
বুঝতেই পারল না যে,
তিনি আসলে একজন
পরাক্রমশালী রাজা।
কথা প্রসঙ্গে রাজা
জানলেন, এই মেয়েটির জন্ম
আর তারনিজের মেয়ের জন্ম
একই দিনে। ভীষণ কৌতহল
হল রাজার। মেয়েটির
প্রতি তার আরও তীব্র মমতা
তৈরি হল। সে সারাক্ষণ
মেয়েটির সঙ্গে সঙ্গে
থাকে। তার সঙ্গে গল্প
করে। তার জন্য বন থেকে ফুল
কুড়িয়ে আনে। শেষে ফুল
দিয়েমেয়েটি মালা
গাঁথে। এমনি করেই দিন
যায়। মেয়েটিকে পেয়ে
রাজা যেন সব দুঃখ
ভুলেগেলেন।
মেয়েটিওযেন ভীষণ
খুশি। এই মানুষটিকে সেও
এক সময় ‘বাবা’
বলেডাকতেশুরু করেদিল।
এদিকে এক রাক্ষসটের
পেয়ে যায় ব্যাপারটি।
সে ভাবে, এমন করেতো আর
চলতে দেওয়া যায় না।
এভাবে চলতে থাকলে তো
একদিন সমস্ত সত্যটাই বের
হয়েআসবে। যা করার,
এক্ষুণি করতে হবে।
সবারআগে মেয়েটার
ঘাড়ই মটকাতে হবে। যেই
ভাবা সেই কাজ। একদিন
বন থেকে রাজার
ফিরতেদেরি হয়ে যায়।
ওদিকে সন্ধ্যাও ঘনিয়ে
আসে। বাবা তো ফিরছে
না। দুশ্চিন্তায় মেয়েটি
ছোটাছুটি করতে থাকে।
ঘর থেকে বাইরে
বেরিয়ে খুঁজতে
থাকেবাবাকে। সেই
সুযোগে রাক্ষসটি
এসেমেয়েটির উপর
ঝাঁপিয়ে পড়ে। মেয়েটি
তো ‘বাবা’ ‘বাবা’ বলে
চিৎকার শুরু করে দেয়। আর
ঠিক সেই সময়েই রাজা
এসে উপস্থিত। রাক্ষস বধের
মন্ত্রও তার জানা। বহুদুষ্টু
রাক্ষসকেই এর আগে উচিৎ
শিক্ষা দিয়েছেন
তিনি। তিনি সরাসরি
আক্রমণ করলেন রাক্ষসকে। আর
যায় কোথায়, দুজনের মধ্যে
শুরুহয়ে গেল তুমুল যুদ্ধ। শেষ
পর্যন্ত মন্ত্রের জোরেজয় হল
রাজারই। রাজা যখন
রাক্ষসকেপ্রাণেবধকরতে
গেলেন, তখন রাক্ষস কেঁদে-
কেটে কাকুতি-মিনতি
করে বলল, “হে
পরাক্রমশালী বিক্রমপুরের
রাজাধিরাজ, দয়া করে
আমাকে প্রাণেবধকরবেন
না। তারচেয়েবরং
আমাকেআজীবন দাস
বানিয়ে রাখুন।
বিনিময়েআমি আপনাকে
রাজাকে এমন এক সত্য বলব,
যার কারণেই আপনার
এতকষ্ট।” কী সত্য?রাজকন্যার
অসুখের পেছনে কোনো
সত্য আছেনাকি? রাজার
বেশ কৌতহল হল। তিনি
রাক্ষসের প্রস্তাবেরাজি
হলেন। তাকে না মেরে
জানতেচাইলেন, সেই
সত্যের ইতিহাস।
রাক্ষসটি তখন বলতে শুরু
করল। এই রাক্ষসের মা
তক্ষোকিনী রাক্ষসী।
তাকে মন্ত্রবলেবধকরেন
রাজা। অপরাধ- রাজ্যের
প্রজাদের ক্ষতিসাধন। তখন
এই রাক্ষস প্রতিজ্ঞা করে,
মায়ের হত্যার প্রতিশোধ
নেওয়ার। সবকিছুর
বিনিময়ে হলেও রাজার
ক্ষতিসাধন সেকরবেই। আর
সে জন্যই রাজারস্ত্রী যখন
সন্তানসম্ভবা, তখন
সেজাদুবলে রাণির গর্ভ
থেকে
রাজকন্যাকেসরিয়ে এই
কুটিরের নারীর গর্ভে
স্থাপন করেন। রাজকন্যার
জন্ম হয় এই কুটিরে। এই
মেয়েটি-ই আসলে রাজার
মেয়ে, বিক্রমপুরের
রাজকন্যা। ওদিকে
রাজার ঘরে জন্ম নেওয়া
অসুস্থ শিশুটি আসলে
রাজকন্যার অর্ধাংশ।
ওদের দুজনকে যদি কোনো
পূর্ণিমার রাতে এক
বিছানায় শোয়ানো
যায়, তবে তারা দুয়ে
মিলে সম্পূর্ণ মানুষে
পরিণত হবে। রাক্ষসের
কথা শুনে রাজা
মেয়েটিকে বুকে
জড়িয়েনিলেন।
মেয়েটিও তার মাকে
নিয়ে ফিরেএল
রাজপ্রাসাদে। বহুদিন পর
রাজাকে পেয়েপ্রজারাও
ভীষণ খুশি। সঙ্গে
রাজকন্যা পাওয়ার খবরে
তাদের তো আনন্দ আর বাঁধ
মানলো না। তারপর এক
পূর্ণিমা রাতে দুই
রাজকন্যাকেএক বিছানায়
শোয়ানো হল। পরদিন
সকালে দেখা গেল, ঘর
থেকে বের হয়েছে এক
অনিন্দ্য সুন্দরী রাজকন্যা।
দিনদিন সেবিদ্যা-
বুদ্ধিতেও
তারপারঙ্গমতারপরিচয়
দিতেলাগল। রাজকন্যার
রূপ-গুণের প্রশংসা ছড়িয়ে
পড়ল দেশ দেশান্তরে।
বিক্রমপুরে রাজা-
রাজকন্যা-প্রজা সবাই
মিলে সুখে-
শান্তিতেদিন কাটাতে
লাগল। আর সেই দুষ্ট রাক্ষস?
রাজার দাস হয়ে দিনরাত
তাকে করতে হয় শক্ত শক্ত
কাজ। এভাবেই সে তার
অন্যায়ের প্রায়শ্চিত্ত
করতে থাকে।
আশা করি গল্তটি ভালো লেগেছে । আপনি যদি এরকম গল্প প্রতিদিন পড়তে চান , তাহলে এখনই দয়া করে এই (
Hot Downloads) লিংকে প্রবেশ করুন ।খোদা হাপেজ।